রমজানে পুরান ঢাকা: সেহরির সময় রেস্তোরাঁ জমজমাট

রাত ২টা। ব্যস্ত ঢাকা যখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তখনও পুরান ঢাকা জেগে আছে দিনের ব্যস্ততার মতোই। ভোজনরসিকদের জন্য বিখ্যাত পুরান ঢাকা সেহেরিবিলাসীদের কাছে স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে।
পরিবার ও প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে সেহেরি উপভোগ করতে দূর-দূরান্ত থেকে সেহেরিবিলাসীরা এসে ভিড় করছেন পুরান ঢাকার বিভিন্ন রেস্তোরাঁয়।
পবিত্র রমজান মাসে আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের ডেকে একসঙ্গে ইফতার করার রীতিটা অনেক পুরনো। হাল জামানায় নাম হয়েছে ‘ইফতার পার্টি’। সঙ্গে এখন যোগ হয়েছে নতুন এক রেওয়াজ। গভীর রাতে পুরান ঢাকার অভিজাত রেস্তোরাঁয় দল বেঁধে সেহেরি খাওয়া।
যাকে বলা হচ্ছে ‘সেহেরি পার্টি’। কয়েক বছর ধরে ঢাকার স্বচ্ছল শ্রেণীর একটি অংশের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে মধ্যরাতের এ সেহেরি পার্টি।
শুধু ধর্মীয় কারণেই এ সেহেরি নয়, নগরজীবনের ব্যস্ততা আর যানজটে হাঁপিয়ে ওঠা ঢাকায় একসঙ্গে সময় কাটাতে মধ্যরাতকেই আদর্শ হিসেবে বেছে নিয়েছেন নগরবাসী।
পাশাপাশি এটি হয়ে উঠেছে প্রিয়জনদের সঙ্গে নিয়ে পুরান ঢাকার মুখরোচক খাবারের স্বাদ নিতে নিতে আড্ডায় মেতে ওঠার আরেক উপলক্ষ।
রেস্তোরাঁ কর্তৃপক্ষ বলছেন, শুরুর দিকে রেস্তোরাঁগুলোতে তরুণদের উপস্থিতিই বেশি ছিল। গেল দু’বছর সপরিবারে সেহেরি খাওয়ার দৃশ্য বেড়েছে অনেক বেশি। সামনের দিনগুলোতে সেহেরিবিলাসীদের ভিড় আরও বাড়বে মনে করছেন রেস্তোরাঁ মালিকরা।
বংশাল, ঠাটারিবাজার, হাটখোলা রোড, নর্থ সাউথ রোড ও রায় সাহেব বাজারের বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় সেহেরি করতে আসা মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রাত্যহিক জীবনের একঘেঁয়েমি কাটিয়ে সেহেরিকে আরও প্রাণবন্ত করার জন্যই মূলত বাইরে সেহেরি করতে আসা।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মাহবুব আলম বিপ্লব পরিবার-পরিজন নিয়ে এসেছিলেন নর্থ সাউথ রোডের আল রাজ্জাক হোটেলে। তিনি বলেন, ‘আমার কর্মক্ষেত্র পুরান ঢাকায় হলেও থাকি ফার্মগেট। দিনের বেলায় ব্যস্ত থাকি।
এ কারণে এখানকার বিখ্যাত রেস্তোরাঁগুলোতে আসা হয় না। এই সময়টা রাস্তাঘাট খালি থাকে, তাই পরিবারের সবাইকে নিয়ে চলে এসেছি সেহেরি খেতে।’ পাশেই বসা মেয়ে মিথিলা তাসনিম জানান, গত বছর এসেছিলেন মা-বাবার ইচ্ছায়। কিন্তু এবার তিনি নিজেই মা-বাবাকে নিয়ে এসেছেন।
মিরপুর থেকে বন্ধুদের সঙ্গে এসেছেন নাভিদ আহমেদ। তিনি বলেন, বেইলি রোডসহ বিভিন্ন জায়গায় ইফতার করেছি। কিন্তু রাতে সেহেরি করার কথা শুধু শুনেছি। বাস্তবে এ অভিজ্ঞতা নিতেই এত দূর থেকে আসা।
ভিড়, উৎসবমুখর পরিবেশ, বিশেষ করে যানজটমুক্ত রাতের ঢাকা শহর-সবই মুগ্ধ করার মতো। নাভিদের বন্ধু আদিল বলেন, আমি এমনিতে ভোজনরসিক। আর রসনার জন্য পুরান ঢাকার রেস্তোরাঁর তুলনা নেই।
তাই বন্ধুরা যখন বলল একসঙ্গে সেহেরি খাবো, আমি এ রেস্তোরাঁর প্রস্তাব দিলাম। সবাই চলে এলাম। হোটেল আল রাজ্জাক ছাড়াও হাটখোলার হোটেল সুপার, ঠাটারিবাজারের হোটেল স্টারে সেহেরি করতে আসা লোকজনের ভিড় দেখা গেল।
এছাড়াও বংশাল ও নাজিরাবাজারের রেস্তোরাঁগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। নাজিরাবাজার মোড়ে কথা হল জুরাইনের রায়হান ইসলামের সঙ্গে। এ বছরই প্রথম এসেছেন। তিনি বলেন, ফেসবুকে বন্ধুরা সেহেরির ছবি আপলোড করে। তা দেখে নিজেরও সাধ জাগল। তাই বন্ধুরা মিলে চলে এলাম। ভালোই লাগছে।
সেহেরির আগে-পরে চা ও জুসের দোকানগুলোতেও ভিড় লক্ষ্য করা যায়। আল-কারিম জুসের মালিক মিলন আহমেদ বলেন, নতুন দোকান দিয়েছি। রমজান ছাড়া চব্বিশ ঘণ্টা দোকান খোলা থাকে। রমজানে সেহেরির সময় পর্যন্ত খোলা রাখি।
জমজমাট দোকান চলে। এ দোকানের কর্মচারী আলমগীর বলেন, বংশালের কিছু কিছু রেস্তোরাঁ সারা বছরই চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। কাস্টমারও পাওয়া যায়। তবে রোজার সময় দিনের ভিড় চলে আসে রাতের বেলায়।
হোটেল আল রাজ্জাকের মালিক মো. মনির যুগান্তরকে বলেন, ২০১০ সালের আগেও সেহেরি পার্টি ধারণাটি ছিল পুরোপুরি অপরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ইন্টারনেটে বিভিন্ন ওয়েব পোর্টালের কল্যাণে জনপ্রিয় হচ্ছে সেহেরি পার্টি।
মো. মনির আরও বলেন, গত তিন থেকে চার বছর ধরে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে সেহেরি পার্টি। আগে এ এলাকার ব্যবসায়ী, কর্মচারী ও আবাসিক হোটেলের গ্রাহকদের জন্যই সেহেরির আয়োজন হতো।
গত কয়েক বছর পরিবার-পরিজন, বন্ধুদের নিয়ে অনেকে সেহেরি করতে আসা শুরু করেন। মূলত তখন থেকেই রীতিমতো জমজমাট এ সেহেরি পার্টির প্রচলন। এখন তো সারা ঢাকা থেকেই লোকজন আসেন। ১০ বছর রেস্তোরাঁয় কাজ করেন রহিম বখস।
Add Comment