ভালোবাসার ফুলে সুবীর নন্দীকে বিদায়

ভালোবাসা শুধু সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়, শিল্পীদের কাছ থেকেও সুবীর নন্দী কুড়িয়েছিলেন। সেটা যেমন জীবদ্দশায়, বিদায়লগ্নে সেটা আরও বেশি। মন ছুঁয়ে যাওয়া গায়কীতে যাদের জীবনের অনেকটা সময় তিনি মাতিয়ে রেখেছিলেন, বিদায়বেলায় সেই শ্রোতা, শুভাকাক্সক্ষী, সহকর্মী, স্বজনদের ভালোবাসার সৌরভে তিনি ভাসলেন। চোখের জলেই ভালোবাসার ফুলে ফুলে তার কফিনটি ভরিয়ে দিয়েছেন তারা।
মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় ভোর সাড়ে ৪টায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন শিল্পী সুবীর নন্দী। বুধবার ভোরে তার মরদেহ দেশে পৌঁছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে মরদেহ তার গ্রিন রোডের বাসভবনে নেয়া হয়। যেখানে স্ত্রী পূরবী নন্দী ও মেয়ে ফাল্গুনী নন্দীসহ প্রিয়জনরা তাকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় আত্মীয়স্বজনের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে চারপাশের পরিবেশ। এরপর তার মরদেহ ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নেয়া হয়। সেখানে ফুলে ফুলে ঢেকে দেয়া হয় তার কফিন। সেখান থেকে মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় সেখানে তার কফিনে নাগরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি জানানো হয়।
শহীদ মিনারে সুবীর নন্দীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত হন সর্বস্তরের মানুষ। শ্রদ্ধা জানাতে যান তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান, গাজী মাজহারুল আনোয়ার, সুরকার শেখ সাদি খান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী, রামেন্দু মজুমদার, মামুনুর রশীদ, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, শিল্পী খুরশিদ আলম, রফিকুল আলম, ফকির আলমগীর, তিমির নন্দী, শুভ্র দেব, ফুয়াদ নাসের বাবু, মানাম আহমেদ, সুমনা হক, রবি চৌধুরী, অ্যান্ড্রু কিশোর, এসডি রুবেল, কুমার বিশ্বজিৎ, খায়রুল আনাম শাকিল, শহীদুল্লাহ ফরায়েজী, চিত্রনায়িকা নূতন, শিল্পী সাব্বির, নিশিতা বড়ুয়া, কিশোর, মুহিন প্রমুখ।
শ্রদ্ধা নিবেদন করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জগন্নাথ হল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জয়বাংলা সাংস্কৃতিক ঐক্যজোট, হবিগঞ্জ খেলাঘর, বেঙ্গল ফাউন্ডেশন, সারগাম ললিতকলা একাডেমি, বাংলাদেশ বেতার নিজস্ব শিল্পী সংস্থা, গণসাক্ষরতা অভিযান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন, দনিয়া সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন, শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ, চট্টগ্রাম মিউজিশিয়ান ক্লাব, জাতীয় রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগ, ছায়ানট, সরকারি সঙ্গীত কলেজসহ বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন।
শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে সুবীর নন্দীর মেয়ে ফাল্গুনী নন্দী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের আর কেউ রইল না। বিশেষ করে আমাকে সারাক্ষণ আগলে রাখতেন বাবা। কলিজার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। আমার একটু কষ্ট হলে পাগল হয়ে যেতেন। বাবা জীবনের শেষ দিনগুলোতে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। লড়াই করা শিখিয়েছেন।’
হাছান মাহমুদ বলেন, কালজয়ী সঙ্গীতশিল্পী সুবীর নন্দী অর্ধশত বছরের সঙ্গীত জীবনে আড়াই হাজারেরও বেশি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রেও অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন তিনি। এ গুণীশিল্পী পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ একুশে পদকে ভূষিত হন। গানের মধ্য দিয়েই তিনি এ দেশের মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন।
শ ম রেজাউল করিম বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের ইতিহাসে অপূরণীয় ক্ষতি হল সুবীর নন্দীর মৃত্যুতে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারণ করতেন। কেএম খালিদ বলেন, জাতীয় আর্কাইভসের মাধ্যমে সুবীর নন্দীর সব কাজকে সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া হবে।
মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, সুবীর নন্দী উচ্চ শিক্ষিত ও মার্জিত ছিলেন। তার সৃষ্টি আমাদের জীবনে দাগ কেটে থাকবে। গাজী মাজহারুল আনোয়ার বলেন, তার গানগুলো আমাদের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সেই অনুপ্রেরণা থেকে নতুন প্রজন্ম যদি অনুসরণ করে তাহলে তারাই উপকৃত হবেন।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, সুবীর নন্দীর চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানের একজন কিংবদন্তির বিদায় ঘটল। তিনি গান করতেন হৃদয় দিয়ে। সুর মাধুর্যে ছুঁয়ে যেতেন মানুষের মন। মামুনুর রশীদ বলেন, সুবীর নন্দীর গানগুলোকে অবিকৃতভাবে গাইতে হবে এবং সংরক্ষণ করতে হবে। তাহলেই তার প্রতি আমরা সর্বোচ্চ সম্মান জানাতে পারব।
রফিকুল আলম বলেন, মৌলিক শিল্পী বলতে যা বোঝায় সুবীর নন্দী তাই ছিলেন। শুধু শিল্পী নন, সঙ্গীতের সৈনিক ছিলেন। তার গান ও ব্যক্তিজীবন দুটোতেই পরিমিতিবোধ ছিল। নাসিরউদ্দীন ইউসুফ বলেন, বাংলা সঙ্গীতের যে ধারাবাহিকতা, সেই ধারাবাহিকতার মধ্য দিয়ে সঙ্গীতের আশ্রয়ে তিনি যে গল্প বলতেন তা অবিস্মরণীয়। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেন, আমাদের সঙ্গীতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ একজন শিল্পী। আমরা শিল্পীরা যেটাকে সত্যিকারের ‘শিল্পী’ বলি। শুদ্ধতার সঙ্গে আমাদের দেশে যারা সঙ্গীত পরিবেশন করতেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। শুধু আধুনিক গান নয়, তার মতো দারুণ ভজন, কীর্তন গাওয়া শিল্পীও আমি আর দেখিনি। বাংলাদেশ আর এরকম শিল্পী পাবে না। কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, একে একে আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনে মহাজনেরা চলে যাচ্ছেন। তাদের রেখে যাওয়া শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না, যা আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য হুমকিস্বরূপ।
শহীদ মিনার থেকে সুবীর নন্দীর মরদেহ এফডিসিতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন চিত্রনায়ক আলমগীর, পরিচালক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান গুলজার, পরিচালক সমিতির মহাসচিব বদিউল আলম খোকন, অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস, শিল্পী সমিতির সাধারণ সম্পাদক জায়েদ খান, চিত্রনায়ক ওমর সানি, ড্যানি সিডাক, পরিচালক শাহ আলম কিরণ প্রমুখ। এফডিসিতে সুবীর নন্দীর কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় তথ্য মন্ত্রণালয়, সেন্সর বোর্ড, চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতি, চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতি, ডিরেক্টর গিল্ড।
এরপর সুবীর নন্দীকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে চ্যানেল আইয়ের প্রধান কার্যালয়ে। চ্যানেল আই কার্যালয়ে শেষ শ্রদ্ধা নিবেদনের সময় উপস্থিত ছিলেন চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর, পরিচালক ও বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ, পরিচালক জহির উদ্দিন মাহমুদ মামুন, মুকিত মজুমদার বাবু, শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা সুবীর নন্দী পরিবারের সদস্যসহ বিভিন্ন অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা।
রামকৃষ্ণ মিশনে আরেক দফা শ্রদ্ধাঞ্জলি শেষে তার মরদেহ সবুজবাগের রাজারবাগ বরদেশ্বরী কালীমন্দির ও শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠিত হয়।
Add Comment