পাহাড়-সমুদ্র-বিলঘেঁষা রেলপথে হাজারও স্বপ্ন

দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ পর্যটন খাতে বিল্পব ঘটাবে। পাহাড়, সমুদ্র আর বিল ঘেঁষে রেললাইন স্থাপন দেশে এটিই প্রথম। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম এ প্রকল্পের কাজ দ্রুত চলছে। দৃশ্যমান হয়ে ওঠা কাজ ইতিমধ্যে ৩১ শতাংশ শেষ হয়েছে।
প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে কক্সবাজারবাসীর অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে।
২০২২ সালের মধ্যেই ট্রেনে চড়ে যাওয়া যাবে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। কক্সবাজারে তৈরি হচ্ছে ‘ঝিনুকের’ মতো আন্তর্জাতিকমানের ‘হাব’ রেলওয়ে আইকন স্টেশন। ১২৯ বছরের এ স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের ভাষ্য, এ লাইন হবে সবচেয়ে লাভজনক ও অত্যাধুনিক। প্রকল্পটি ট্রান্স এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।
প্রকল্প এলাকায় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পাহাড়, নদী, সমুদ্র আর বিল ঘেঁষে নির্মিত হওয়া প্রকল্পে শত শত শ্রমিক কাজ করছেন। অত্যাধুনিক সরঞ্জাম আর আধুনিক পদ্ধতির সমন্বয়ে লাইন স্থাপনের কাজ চলছে। পুরো প্রকল্পটিকে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম পর্বটি হচ্ছে দোহাজারি থেকে চকরিয়া, রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার। বাকি ২৮ কিলোমিটার রামু থেকে মিয়ানমার সীমান্তের ঘুমধুম পর্যন্ত।
এ এলাকায় পুরোদমে কাজ চলছে। অধিকাংশ এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে, তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট রেলওয়ে ব্রিজ। সম্পূর্ণ পথ মাটি ভরাট ও ব্রিজগুলো পুরোপুরি সম্পন্ন হলে লাইন স্থাপনের কাজ শুরু হবে। চট্টগ্রাম-কক্সবজার-ঘুমধুম রেললাইনের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মো. মফিজুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, আমাদের স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে।
সরেজমিন দেখা যায়, কক্সবাজার সমুদ্র এলাকার চৌধুরীপাড়া ঝিলংজা মোজায় ৮৮ একর জমির ওপর নির্মিত হচ্ছে ঝিনুক আকৃতির রেলওয়ে স্টেশনটি। মাটি ভরাটের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। দিনরাত উন্নয়ন কাজ চলছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পর্যটক আকর্ষণ করার জন্যই সেখানে ট্রান্স এশিয়ান ‘হাব’ আইকনিক ইন্টারন্যাশনাল রেলওয়ে স্টেশন নির্মাণের পরিকল্প নেয়া হয়। স্টেশনটি দেখলেই মনে হবে এটি সমুদ্রসৈকতের স্টেশন।
কক্সবাজার, রামু, ইসলামাবাদ, ডুলাহাজরা, মেধাকচ্চপিয়া, দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ, সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ রাতদিন চলছে। ২৪ ঘণ্টা কাজ করে যাচ্ছেন শ্রমিকরা। প্রকল্পের আওতাধীন চারটি বড় সেতুসহ ২৫টি সেতুর নির্মাণকাজও শুরু হয়েছে। বড় সেতুগুলো নির্মিত হচ্ছে মাতামুহুরী নদী, মাতামুহুরী শাখানদী, খরস্রোতা শঙ্খ ও বাঁকখালী নদীর ওপর। অধিকাংশ ছোট ব্রিজের কাজ শেষ হয়েছে, এসব ব্রিজে শুধু লাইন স্থাপনের কাজ বাকি রয়েছে।
প্রকল্প পরিচালক মো. মফিজুর রহমান যুগান্তরকে জানান, এ প্রকল্পে দুটি দেশীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। শতভাগ জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে দিনরাত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড বহু বছর ধরে রেলওয়েতে কাজ করছে। একই সঙ্গে অপর ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তমা কনস্ট্রাকশন কোম্পানির অভিজ্ঞতা রয়েছে বহু বছরের। এ দুটি দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চীনের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান সিআরইসি ও সিসিইসিসি কাজ করছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের কাজ প্রায় ৩১ শতাংশ শেষ হয়েছে। কাজ শুরুর তিন বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করার কথা। কিন্তু বাস্তবায়ন কাজ দেরিতে শুরু হওয়ায় ২০২২ সালের আগে নতুন লাইনের ওপর রেলের চাকা ঘোরার সম্ভাবনা নেই। তবে যে গতিতে কাজ চলছে, ২০২২ সালের জুনে এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হবে নিশ্চিত।
রেলপথ মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হচ্ছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এ প্রকল্পে অর্থের জোগান দিচ্ছে। ভূমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিতে ২ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে।
নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন সম্ভব না হলে প্রকল্প ব্যয় বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। ১২৮ কিলোমিটার রেলপথের মধ্যে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া, কক্সবাজারের চকরিয়া, ডুলাহাজরা, ঈদগাহ, রামু, সদর ও উখিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম স্টেশন পর্যন্ত একযোগে কাজ চলছে। এদিকে রামুতে নতুন সেনানিবাস হওয়ায় রামু-ঘুমধুম পর্যন্ত ২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণকাজ আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে।
প্রকল্প এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, এ প্রকল্প তাদের জন্য আশীর্বাদসরূপ। পাহাড়, টিলা, নদী-নালা আর সমুদ্রঘেঁষা এ প্রকল্প শেষ হলে কক্সবাজারে মানুষের ঢল থাকবে সবসময়। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যি থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজনও নানা ধরনের কর্মে সম্পৃক্ত হতে পারবে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, এ প্রকল্প শেষ হলে দেশি-বিদেশি পর্যটকে সবসময় ভরপুর থাকবে কক্সবাজার। প্রতি সপ্তাহে পর্যটন খাতে ৮০০ থেকে ১ হাজর কোটি টাকা ব্যবসা করা সম্ভব হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গে কক্সবাজারে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে আরও বিনোদনের ব্যবস্থা করা হলে সাধারণ মানুষ আরও ভ্রমণে উৎসাহী হবেন।
ম্যাক্স গ্রুপ ও ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের চেয়ারম্যান ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, এ প্রকল্পটি প্রধানমন্ত্রী ‘শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগ’ খ্যাত ১০ প্রকল্পের অন্যতম একটি। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মধ্য হাজারও স্বপ্ন রয়েছে। আমরা রাতদিন কাজ করছি। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পর্যাপ্ত শ্রমিক, আধুনিক ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম ব্যবহার করে দ্রুত গতিতে প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। কক্সবাজারে ঝিনুকের মতো যে স্টেশনটি নির্মাণ করা হচ্ছে, তা প্রধানমন্ত্রীর পছন্দে। এশিয়ার মধ্যে এ স্টেশন হবে আকর্ষণীয়।
ইঞ্জিনিয়ার গোলাম মোহাম্মদ আলমগীর বলেন, এ প্রকল্পে এখনও কিছু জায়গায় বাড়িঘর রয়েছে। ওইসব জায়গা বুঝে পেলে আমরা আরও দ্রুতগতিতে পুরোদমে কাজ চালিয়ে যেতে পারব। নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এ প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হবে। সারা দেশ থেকে ট্রেনে সরাসরি কক্সবাজারে যেতে পারবে ভ্রমণপিপাসুরা। এ প্রকল্প দেশীয় ঠিকাদাররা প্রতিষ্ঠা করছে, এটাও গর্ব ও অহংকারের। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, তার সেই দুর্দান্ত স্বপ্নে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ সমাপ্ত করে অংশীদার হতে চাই মাত্র। রেলপথমন্ত্রী মো. নুরুল ইসলাম সুজন যুগান্তরকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রেলের ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত রেলওয়ের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছেন। দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পটি তারই পরিকল্পনা। ১২৯ বছরের স্বপ্ন তিনি বাস্তবায়ন করছেন। দেশীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান এ প্রকল্প নির্মাণ করছে, এটি আমাদের জন্য গর্বের। উন্নয়ন প্রকল্পে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে নেয়া দরকার। চায়না কোম্পানিও সহযোগিতায় রয়েছে। এ প্রকল্প শেষ হলে দেশে পর্যটক বিল্পব ঘটবে। সাশ্রয়মূল্যে সাধারণ মানুষ ভ্রমণ করতে পারবে। এতে যাত্রীসেবার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে এ রুটটি। এ প্রকল্পটি টান্স এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়ে চীন, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড পর্যন্ত সম্প্রসারণ করা হবে।
Add Comment