পনেরো বছর পর রায় আপিল শুনানি কবে

নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে ২০০২ সালের ১২ মার্চ খুন হন ৪ যুবক। এ ঘটনায় হত্যা মামলা করেন নিহত একজনের বাবা। ১৫ বছর পর ২০১৭ সালের ১৭ মে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ মামলার রায় দেন। সদাসদি ইউনিয়নের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল বাশার কাশুসহ ২৩ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত।
এর মধ্যে কারাগারে আছেন ১৮ আসামি, মারা গেছেন ১ জন, ৪ জন পলাতক। ওই বছরই এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি আসামিরা ক্রিমিনাল আপিল ও জেল আপিল করেন। কিন্তু মামলাটি এখনও শুনানির জন্য কার্য তালিকায় আসেনি। কবে শুনানি হবে কেউ বলতে পারছেন না।
মামলার আসামি ইয়াকুব আলীর ছেলে শরিফুল ইসলাম বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আমরা হাইকোর্টে আপিল করেছি। এখনও তালিকায় আসেনি। কবে শুনানি হবে তাও জানি না। তিনি বলেন, আমার বাবা সম্পূর্ণ নির্দোষ। কারাগারের কনডেম সেলে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আমি মামলাটি দ্রুত শুনানির দাবি জানাই।
জানতে চাইলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান রুবেল বলেন, হাইকোর্টে বর্তমানে ২০১৩ ও ২০১৪ সালে আসা ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি চলছে। সে হিসাবে আড়াইহাজারের ৪ খুনের মামলাটির শুনানি হতে পারে ২০২২ বা ২০২৩ সালে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হলে ভিন্ন কথা। এটা সম্পূর্ণ প্রধান বিচারপতির ওপর নির্ভর করে।
শুধু এ ৪ খুন মামলা নয়, এমন উদাহরণ রয়েছে বহু। এক শিশুকে খুনের দায়ে আড়াইহাজার উপজেলার আবদুস সাত্তারের ছেলে আবুকে (২২) ২০১১ সালে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। তখন থেকে কনডেম সেলে আছেন তিনি। মামলার ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল শুনানি এতদিনে (৮ বছর) এসেছে কার্যতালিকায়। কিন্তু শুনানি শুরু হয়নি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, দেশে মোট মামলা দায়ের থেকে নিষ্পত্তির হার কমেই চলছে। বিচারক স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও ব্যবস্থাপনা ত্রুটির কারণে সৃষ্টি হচ্ছে মামলা জট। এছাড়া আইনের দুর্বলতার কারণে নিম্ন আদালতে বিচারাধীন কয়েক লাখ মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত হয়ে রয়েছে। যার কারণে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ছে না।
মামলা জট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় জট কমাতে হলে মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্টদের নিতে হবে মহাপরিকল্পনা।
তিনি বলেন, মামলা নিষ্পত্তির সংখ্যা কমার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন, অনেক মামলার ক্ষেত্রে দেখা যায়, বিচার শেষ না হওয়ার আগেই বিচারককে অন্যত্র বদলি করা হয়। এক্ষেত্রে নতুন বিচারক এসে মামলাটি বুঝতে সময় লাগে। অনেক মামলা আছে নতুন করে শুনানি করা হয়। এছাড়া মামলায় সাক্ষী না আসার কারণে অনেক সময় মামলা এগোতে পারে না। সময়মতো সাক্ষীকে উপস্থাপন না করায় বিচার সম্পন্ন হতে সময় লাগছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেয়। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ চাইলে বিচারক ও তাদের সহায়ক লোকবল বাড়াতে হবে, এর আগে ব্যবস্থাপনায় একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা দরকার।
জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী আরও বলেন, আদালতের বাইরে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে মামলা জট কমিয়ে আনা সম্ভব। এ লক্ষ্যে আইনও সংশোধন করা হয়েছে। আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নিষ্পত্তিতে বছরের পর বছর লাগছে। রায় যখন মেলে, তখন প্রাসঙ্গিকতাই থাকে না। শফিক আহমেদ বলেন, মামলা জট কমাতে হলে সর্বোচ্চ এক বা দু’দিন মুলতবি করে দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, গত বছর সারা দেশে অসংখ্য গায়েবি মামলা হয়েছে। এ সরকারের শাসন ব্যবস্থায় মিথ্যা মামলা দায়েরের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু বিচারকের সংখ্যা বাড়ছে না। ভুয়া মামলা করার প্রবণতা বন্ধ করলে মামলা জট অনেকটা কমবে।
সুপ্রিমকোর্টে মামলা জট দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনও। বৃহস্পতিবার জরুরি ফুল কোর্ট সভা করেন। সেখানে জট নিরসনে আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বিচার কাজ পরিচালনার জন্য বিচারকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
সভায় অন্যান্য বিচারপতিরা দ্রুত বিচারক নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দেন। তারা বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের বিচারকের সংখ্যা কম। সে হিসাবে তুলনামূলক মামলা নিষ্পত্তির হার অনেক বেশি।
এর আগে ২৮ এপ্রিল এক মামলার শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, সুপ্রিমকোর্টে বর্তমানে এত মামলা যে ফাইল রাখার মতো জায়গা নেই। অনেকটা ক্রিটিক্যাল অবস্থা, এভাবে চলতে পারে না।
এর আগের এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারক সংকট, অবকাঠামোগত অপ্রতুলতাকে মামলা জটের অন্যতম কারণ মনে হলেও শুধু বিচারক বা অবকাঠামোগত উন্নয়ন দিয়ে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।
সুপ্রিমকোর্টের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর দেশে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩৫ লাখ ৭ হাজার ৮৯৮টি। ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর তা দাঁড়ায় ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টিতে। এর মধ্যে নিম্ন আদালতে ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি, সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে ৫ লাখ ১৬ হাজার ৬৫২টি এবং আপিল বিভাগে ২০ হাজার ৪৪২টি মামলা বিচারাধীন।
এতে দেখা যায়, এ ৩ মাসে বিচারাধীন মামলা বেড়েছে ৬১ হাজার ৮৫২টি। মামলা করা হয়েছে ৪ লাখ ৪৭ হাজার ৮৫৪টি এবং নিষ্পত্তি হয়েছে ২ লাখ ৮৭ হাজার ১৩১টি।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বরে সব আদালত মিলে বিচারাধীন মামলা ছিল ৩১ লাখ ৫৬ হাজার ৮৭৮টি। পরের ২ বছরে বেড়েছে ৪ লাখ ১২ হাজার ৮৭২টি। ঢাকা জেলার সব আদালতে বর্তমানে বিচারাধীন মামলা (দেওয়ানি ও ফৌজদারি) হচ্ছে ৪ লাখ ৫৫ হাজার ৪২৯টি। ৩ মাস আগে তা ছিল ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪৭১টি। এ ৩ মাসে বেড়েছে ১৩ হাজার ৯৫৮টি মামলা।
বর্তমানে হাইকোর্টে বিচারপতি রয়েছেন ৯২ জন। ৩৫টি দ্বৈত ও ১৯টি একক বেঞ্চে গত বছরের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ মাসে বিভিন্ন শ্রেণীর (ফৌজদারি, দেওয়ানি ও রিট) মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১৬ হাজার ৩০৬টি। আর আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ১ হাজার ৯২৮টি।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সম্প্রতি জাতীয় সংসদে বলেন, বর্তমানে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৫ লাখ ৬৯ হাজার ৭৫০টি। বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে। বর্তমান সরকার মামলা জট কমানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত অধস্তন আদালতে ৫৭১ জন সহকারী জজ নিয়োগ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট/চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণ বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা পদায়ন করা হয়েছে। এছাড়া ১২তম জুডিশিয়াল সার্ভিস নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে সহকারী জজ নিয়োগের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
Add Comment